কলকাতা 

CPIM : সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কেন মোহাম্মদ সেলিমকে করা হলো, নেপথ্য রহস্য কি? দল কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

শেয়ার করুন

বুলবুল চৌধুরী : ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার দিন থেকে এ দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবদান এই পার্টির মধ্যে সব সময় বিরাজ করেছে। কমরেড মোজাফফর আহমেদ বা কাকাবাবু, সৈয়দ মনসুর হাবীব উল্লাহ ,আব্দুল্লাহ রাসুল, সৈয়দ শাহিদ উল্লাহ, হাসিম আব্দুল হালিম, মোহাম্মদ আমীন এরকম অসংখ্য নাম করা যেতে পারে যাদের সংগ্রামে পুষ্ট হয়ে বাংলা তথা ভারতে কমিউনিস্ট দল বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সিপিএম দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘু পরিবারের কোন সন্তানকে দলের মাথায় বসানো হয়নি।

যদিও মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে বিভক্ত পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন সবচেয়ে বেশি দানা বেঁধেছিল। তা সত্ত্বেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর থেকে কোন মুসলিম ব্যক্তিকে এই রাজ্যের দলের সর্বোচ্চ কর্তা করা হয়নি। সে দিক থেকেই বলা যেতেই পারে প্রায় ছয় দশক পর রাজ্য সিপিএমের মাথায় বসলেন এক সংখ্যালঘু মুখ। তাঁর নাম মোহাম্মদ সেলিম।

Advertisement

মোহাম্মদ সেলিম সাহেবের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে কারো মনে কোন প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। তিনি ডিওয়াইএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তার স্বীকৃতি দিতেই হবে। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বহুদিন থেকে আছেন, পলিটব্যুরোর সদস্য আছেন। এই প্রেক্ষাপটে মোহাম্মদ সেলিম সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদে সর্বসম্মত ভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। সেলিম সাহেব রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

তৃণমূল ঘেষা মুসলিম নেতাদের কাছ থেকে নানারকম টিপ্পনী ভেসে উঠছে। কেউ কেউ বলেছেন বা লিখেছেন, মুসলিম ভোটের জন্য মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করেছে সিপি এম। বিগত ৩৪ বছরের শাসনের বামেরা এরাজ্যের সংখ্যালঘুদের জন্য বলার মত কিছু করেনি অথচ সেই সংখ্যালঘু ভোট নেওয়ার জন্য মোহাম্মদ সেলিমকে  রাজ্য সম্পাদক করেছে সিপিএম। অন্যদিকে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, মুসলিম ভোটব্যাংকে নিজেদের দিকে টানার লক্ষ্যেই মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করেছে সিপিএম। যুক্তি এবং বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত আছেন যে সকল মুসলিম নেতারা তাদের বক্তব্যের সঙ্গে রাজ্য বিজেপির সভাপতির বক্তব্যে এর মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। বিজেপি এবং তৃণমূলের মুসলিম নেতারা মনে করছেন মুসলিম ভোটের জন্য মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করেছে সিপিএম।

এখানেই আমাদের বক্তব্য হল তৃণমূল নেতাদের প্রতি বামেদের কাছ থেকে অন্তত একটু শিখুন রাজ্য সম্পাদক পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে তারা সংখ্যালঘু সমাজের একজন ব্যক্তিকে বসিয়েছেন, তৃণমূল নেতৃত্ব সে কাজটা করে উঠতে পারেননি। একথা বলতে কোথাও বাধা নেই তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর এই রাজ্যে মুসলিম সমাজকে যতখানি তাচ্ছিল্য অবহেলা করছে মমতা প্রশাসন স্বাধীনতার পর আর কোনো সরকার ততখানি তাচ্ছিল্য করেনি। বামেরা ৩৪ বছর ধরে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ করেনি বলে যে অভিযোগ সেটা স্বীকার করে নিয়েও আমরা বলতে পারি ২০০৬-১১ সালের মধ্যে পাঁচ বছরে বামফ্রন্ট সরকার এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সার্বিক উন্নয়নে যে কাজ করেছে তা বিগত ১০ বছরে তৃণমূল সরকার  তা করতে পারেনি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন এর প্রজেক্ট গুলোকে বাস্তবায়ন করেনি গত দশ বছরে তৃণমূল সরকার।

আর অন্যান্য ক্ষেত্রে তো বলার কিছু নেই। সবই তো চোখের সামনে ভাসছে। সিপিএম দল ৩৪ বছর ধরে কী করেছে আর কী করেনি সে বিশ্লেষন করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না শুধু এটুকু বলা যেতে পারে সিপিএমের শেষ পাঁচ বছরে সংখ্যালঘু উন্নয়নে তারা যে কাজ করে গেছে সে কাজ তৃণমূল সরকার এখনও করে উঠতে পারেনি।

এবার আসা যাক মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক কেন করা হলো তা নিয়ে কিছু আলোচনা। ভারতের রাজনীতির দিকে তাকালে ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিজেপি বাদে অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল নরম হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করেছে। কংগ্রেস তৃণমূল থেকে শুরু করে আপ পর্যন্ত সবাই নরম হিন্দুত্বকে রাজনীতির হাতিয়ার করেছে। এই প্রেক্ষাপটের বিজেপির মোকাবিলা করতে হলে নরম হিন্দুত্ব নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে সামনে তুলে আনা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলির মানুষের কাছে এ বার্তা দেওয়াটা জরুরি ছিল হিন্দুত্ব নয় দেশের মূল সমস্যা রুটি কাপড়া মাকান। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি কমাতে হবে এসবই হওয়া উচিত সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান স্লোগান এবং দায়িত্ব। ধর্মের শ্লোগান নয় ভাতের স্লোগান সামনে আনা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা থেকে দেশের রাজনীতিতে দিশা দেওয়ার লক্ষ্যে মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক হিসাবে বেছে নিল সিপিএম বলে মনে করা হচ্ছে।

এর ফলে এই রাজ্যের মুসলিম ভোট বামেদের পক্ষে যাবে কি যাবে না সেটা বড় কথা নয় বড় কথা হল ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ নীতিকে বাস্তবায়ন করা। এই রাজ্যের ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যদি যোগ্যতা এবং দক্ষতা থাকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের সর্বোচ্চ পদে বসতে পারেন এই বার্তাটা দেওয়া জরুরি ছিল। আর সেই বার্তা দিল মোহাম্মদ সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করে সিপিএম।

তবে ক্ষেত্রে এটা মোহাম্মদ সেলিমের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা ঠিকই মোহাম্মদ সেলিম একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে শুধুমাত্র নিজের মেধা এবং সাংগঠনিক শক্তির জোরে সমগ্র দেশে পরিচিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। আর সেই মেধা শক্তিকে ভর করে এই রাজ্যে সিপিএমের হারানো জমি যদি মোহাম্মদ সেলিম ফিরিয়ে আনতে পারেন তাহলে অন্তত ইতিহাস অন্য কথা বলবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাফল্যই শেষ কথা বলে মোহাম্মদ সেলিম সেই সাফল্য দেখাতে পারবেন কিনা সেদিকেই আমাদেরকে তাকিয়ে থাকতে হবে।

তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই স্বাধীন ভারতের প্রথম পশ্চিমবাংলার মত খন্ডিত বাংলায় একজন সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তানকে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হলো। এই বার্তাটা আমাদের মনে হয়েছে গ্রামবাংলায় পৌঁছে যাবে সেক্ষেত্রে এই রাজ্যের শাসক তৃণমূল দলকে অনেকটাই চ্যালেঞ্জে ফেলা যাবে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার সময় তৃণমূল দল যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ব্যবহার করেছিল এবং তাদেরকে নিচের স্তরে বিভিন্ন পদে রাখা হয়েছিল 2021 সালে তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর সেই সব পথ থেকে ঐ সকল ব্যক্তিদের সরানো হচ্ছে। হলে আগামী দিনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি যে হতে পারে তৃণমূল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কেন কোনো নেতা বা ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট দেয়া হবে না।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই গুজরাটে ২৫ শতাংশ প্যাটেল গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী পদে প্যাটেল গোষ্ঠীকেই রাখা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঠাকুর সম্প্রদায়ের মানুষ মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ ঠাকুর সম্প্রদায়ের নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী  করা হয়েছে, তাহলে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন একটা ধর্মনিরপেক্ষ দলের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে অভিষিক্ত হবেন না এই প্রশ্নটা সামনে আসতে শুরু করবে।

মোহাম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই অনেক সেকুলার দল বলে কথিত রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ আসতে থাকবে সিপিএম যদি সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তানকে সর্বোচ্চ পদে বসাতে পারে তাহলে কেন সেকুলার দল হিসাবে কথিত তৃণমূল কংগ্রেস পারবে না! এই প্রশ্নটা আগামী দিনে সামনে আসতে চলেছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

তাই মোহাম্মদ সেলিমকে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক করে শুধু নিজের দলের স্বার্থটা কেই চরিতার্থ করেননি বরং এই রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অবশেষে বলব সাফল্যের শেষ কথা বলবে মোহাম্মদ সেলিম যদি রাজ্য সম্পাদক হিসাবে তৃণমূল সিপিএম দলকে সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেন তাহলে আগামী দিনে এই মডেল সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই ব্যবহার করতে হবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। কারণ মনে রাখতে হবে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজের নিঃস্বার্থ ভোটের বিনিময়ে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আগামী দিনে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজ যে রাজনৈতিক দলের পাশে থাকবে সেই রাজনৈতিক দলই কিন্তু ক্ষমতার ভাগি দার হবে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিজেপির নেতারাও শুনে রাখতে পারেন আমার এই ভবিষ্যৎবাণী বিজেপি কেউ যদি পশ্চিমবাংলায় জিতে ক্ষমতায় যেতে হয় বা মমতাকে হারাতে হয় তাহলে অন্তত ১০ শতাংশ মুসলিম ভোট প্রয়োজন হবে ।

মুসলিম ভোটের একটা অংশ ছাড়া নবান্ন দখলের স্বপ্ন কোন রাজনৈতিক দলের সফল হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ